পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কান্না কবে বিশ্ববিবেককে জাগাবে?

পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের কান্না কবে বিশ্ববিবেককে জাগাবে?

অধিকারহারা মানুষের আহাজারি আর লাশের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে আরাকানের আকিয়াব হয়ে বাংলাদেশের টেকনাফ থেকে থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া আর ইন্দোনেশিয়ার সাগরছোঁয়া সবুজ গহিন বন। কিন্তু কেন আজ ওরা অধিকারহারা? কেন ওরা নিজের আবাসভ‚মি ছেড়ে সাগরে ভাসছে? জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি জমাচ্ছে অজানা-অচেনার পথে? এই প্রশ্নের উত্তর কারো অজানা নয়। কিন্তু তারপরও সাহায্যের হাত বড় অপ্রতুল। বিশ্ববিবেক বড় নিশ্চুপ। একটি দেশে অগণতান্ত্রিক শাসন, উগ্রজাতীয়তাবাদ আর ক্ষমতালিপ্সা মানুষের পাশবিকতাকে কতটা উসকে দিতে পারে, তারপরই বাস্তবচিত্র আজকের এই অসহায় মানুষের আর্তচিৎকার। ১৯৯১ সালে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অত্যাচার নির্যাতন থেকে আত্মরক্ষা করতে আরাকান থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা আশ্রয়ের সন্ধানে বাংলাদেশে আসে। নির্যাতিত এই মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকেই আরো উন্নত জীবনযাপনের আশায় এখান থেকে পাড়ি জমায় সুদূরের সৌদি আরব আর অদূরের মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়। সম্প্রতি থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে শত শত গণকবর আবিষ্কার এবং সাগরপথে নৌকায় করে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিতে গিয়ে হাজার হাজার বনি আদমের মৃত্যু এবং খাদ্য-বস্ত্রহীন অবস্থায় সাগরে ভেসে বেড়ানোর ঘটনায় নতুন এক প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। কেন বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্য দেশে যাচ্ছে? যদিও কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, এরা রাষ্ট্রহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া সরকার ও বিশ্বমিডিয়া বলছে, এদের বেশির ভাগই বাংলাদেশের নাগরিক। দেশে কর্মসংস্থানের অভাব এবং বর্তমান সরকারের বিরোধীদল নির্মূল অভিযানের শিকার হয়ে অত্যাচার নির্যাতন থেকে বাঁচতে এই অসহায় মানুষগুলো মাতৃভ‚মির মায়া ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগরপথে নৌকায় করে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। রাষ্ট্রহারা নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের সাথে এরা এক কাতারে মিশে গেছে। রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে ১৯৯১ সালে। সেই সময় ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে চলে আসে। পর্যাপ্ত খাদ্য ও ওষুধ ছাড়াই ৩ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বর্তমানে বাংলাদেশের অস্থায়ী আশ্রয় শিবিরে অবস্থান করছে। কারো মতে এ সংখ্যা ৫ লাখেরও বেশি। গণতন্ত্রহীনতা কিভাবে একটি জাতিকে উগ্রজাতীয়তাবাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করে সাম্প্রদায়িক পশুতে পরিণত করে তার নিকৃষ্টতম উদাহরণ এককালের বার্মা আজকের মিয়ানমার। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর দেশ মিয়ানমার। বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের মূল দর্শন হলো, ‘অহিংসা পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহাপাপ। নির্বাণেই পরম সুখ।’ কিন্তু গণতন্ত্রহীন দেশের সামরিক জান্তার দোসর হয়ে ধর্মগুরু বৌদ্ধভিক্ষুরা এক একজন দস্যু সরদারে পরিণত হয়েছেন। তাদের নেতৃত্বে চলছে নিরীহ রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীকে নিধন এবং নির্মূল অভিযান।মিয়ানমারে মুসলিম নির্যাতনের ইতিহাস
ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে জানা যায়, এই উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে ক’টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তথা বর্তমান রাখাইন প্রদেশ তার অন্যতম। বর্তমান রোহিঙ্গারা সেই আরকানি মুসলমানদের বংশধর। এক সময় আরাকান স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র ছিল। ১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন ২০০ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা সান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোগল শাহজাদা সুজাকে সপরিবারে হত্যা করে। এই সময় থেকেই মূলত বিরতি দিয়ে দিয়ে চলছে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন ও নির্যাতন। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। তিনিও ছিলেন ঘোর সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলমানদের শহীদ করেন। ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজ দখলে গেলে অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন ঘটে। তবে ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং অন্তত ৩০ লাখ মুসলমান শহীদ হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু মুসলমানদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীন দেশের সরকার আজ পর্যন্ত তাদের নাগরিক ও মানবিক অধিকার দেয়নি। অত্যাচার নির্যাতন ও বিতাড়নের মুখে বহু রোহিঙ্গা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহুদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। এরা বিশ্বের রাষ্ট্রহীন নাগরিক। ১৯৮২ সালে সে দেশের সরকার যে নাগরিকত্ব আইন করেছে, তাতে তিন ধরনের নাগরিকের কথা বলা হয়েছে। এর কোনোটির মধ্যেই রোহিঙ্গারা নেই। সরকারিভাবে তাদের সে দেশে বসবাসকারী বা ‘জবংরফবহঃং’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের সাংবিধানিক ও আর্থসামাজিক অধিকার নেই। তারা একার্থে বন্দী। কারণ মিয়ানমারের অন্য স্থানে তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া যেতে পারে না। এক সময় যে আরাকান মুসলিমপ্রধান ছিল, এখন সেখানে রাখাইন বসতি বাড়িয়ে তাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে।
নির্যাতনের ধারাবাহিকতায় আরাকানের নাম বদলে রাখাইন প্রদেশ প্রতিষ্ঠা
মুসলমান জনগোষ্ঠীকে চ‚ড়ান্তভাবে নির্মূল করার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে ১৯৮৯ সালে আরাকান রাজ্যের নাম বদলে রাখাইন প্রদেশ করা হয়। একই সময়ে বার্মার নামকরণ করা হয় মিয়ানমার। মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে অবর্মী ও অবৌদ্ধ বলে অভিহিত করা হয়। নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাদের বিদেশী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। শুধু তাই নয়, তাদের ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মায় এসে বসতি স্থাপনকারী ‘অবৈধ বাঙালি অভিবাসী’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়, যা ঐতিহাসিকভাবে চরম জালিয়াতি। সত্তর দশকের শুরুর দিকে বার্মিজ সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জাতিকে জাতিগোষ্ঠীগতভাবে নির্মূলের অভিযান শুরু করে। প্রথম দিকের এ ধরনের একটি অপারেশনের নাম ছিল নাগা মিন বা কিং ড্রাগন। বার্মায় কথিত ‘অবৈধ অভিবাসী’ চিহ্নিত ও তাদের বহিষ্কার করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালে এ অপারেশন পরিচালনা করা হয়। বৌদ্ধ পুরানের কিং ড্রাগনের প্রতীকের সাথে মুসলমানদেরকে তুলনা করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়। ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে এক ভীতিকর অবস্থার সৃষ্টি করে অনির্বাচিত সামরিক শাসক। তারা জনগণকে বোঝায় মিয়ানমারের ঐতিহ্য বৌদ্ধ ধর্ম রক্ষা করতে হলে তাদের বিকল্প নেই। আরাকানি মুসলমানদেরকে বিদেশী আখ্যা দিয়ে তাদের কথিত ‘হুমকি’ থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্রতা রক্ষায় সামরিক বাহিনীর ব্যাপকভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল পরিচয় যাচাই। এ অভিযান চলাকালে রোহিঙ্গারা ব্যাপকভিত্তিক ধর্ষণ, নির্বিচার গ্রেফতারের শিকার হন। বার্মিজ সৈন্যরা মসজিদ ও বাড়িঘর ধ্বংস করে এবং জমিজমা দখল করে নেয়। মসজিদের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে ওই অঞ্চলের সেনানিবাসের অভ্যন্তরের রাস্তা নির্মাণ করা হয়। এ সময় গণহারে মুসলমানরা দেশত্যাগ করতে শুরু করেন। মাত্র তিন মাসের মধ্যে প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। পরে তাদের অনেকেই জীবনের ঝুঁকি থাকা সত্তে¡ও মাতৃভ‚মির মায়ায় আবার দেশে ফিরে যায়।
১৯৯১ সালে রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীকে মিয়ানমার থেকে বহিষ্কারের লক্ষ্যে সেনাবাহিনী আবার ‘অপারেশন পাই থায়া’ বা ‘পরিষ্কার ও সুন্দর জাতি অপারেশন’ নামে দ্বিতীয় অভিযান শুরু করে। ২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এ সময় আবার পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। ১৯৯৪ সালে মিয়ানমারের এক স্থানীয় আইনবলে রোহিঙ্গাদের দু’টির বেশি সন্তান নেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। বহু রোহিঙ্গাকে জোর করে নির্মাণকাজে শ্রম দিতে বাধ্য করা হয়। তাদেরকে দাস হিসেবে ব্যবহার করা হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বার্মিজ সেনাবাহিনীর সদস্যরা রোহিঙ্গা নারীদের পতিতাবৃত্তিতে লিপ্ত হতে বাধ্য করে এমন গুরুতর অভিযোগও রয়েছে।
২০১২ সালে আবার রাখাইন বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের নির্মূলে দাঙ্গা শুরু করে। এতে সরকারি হিসাবে ১৯২ জন নিহত হওয়ার কথা স্বীকার করা হলেও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, নিহতের সংখ্যা এক হাজারেরও বেশি। উগ্র-সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধরা মুসলমানদের গ্রামগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ১ লাখ ২৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার সরকারের চোখে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের নাগরিক নয়। তাই তাদের আশ্রয়ের দায়িত্ব মিয়ানমার সরকারের না।
মিয়ানমারের বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘৯৬৯’ সংগঠনের নামে এক আন্দোলন শুরু করেছে। এর নেতৃত্ব দেন মান্দালয়ের এক মঠের প্রধান ভিক্ষু উগ্র সা¤প্রদায়িক নেতা ইউ উইরাথু। তিনি স্থানীয় বৌদ্ধদের জাতীয়তাবাদী ধ্যান-ধারণায় উদ্দীপ্ত হয়ে মুসলমানদের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য এমনকি তাদের দোকানপাট বর্জনের জন্য উৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারে ইসলাম বা মুসলমানের কোনো স্থান নেই। ২০১২ সালে মধ্য মিয়ানমারের মেইকটিলায় ৯৬৯ সংগঠনের অনুসারী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উসকানিতে সংঘটিত দাঙ্গায় মুসলমানদের ১ হাজার ৩০০ বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। ৪৩ জন মুসলমানকে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সরকারের স্বীকৃত ১৩৫টি জাতি-গোষ্ঠীর একটি ও দেশের বৈধ নাগরিক রাখাইন প্রদেশে বসবাসরত যারা রোহিঙ্গা নয় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা তুচ্ছ ঘটনায় তাদের ওপর হামলা চালায় ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
আরাকানে ইসলামের আগমন
আরাকান বা বর্তমান রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকে মিয়ানমার সরকার বিদেশী আখ্যা দিলেও ঐতিহাসিক সত্য হলো আরাকান অতি প্রাচীনকাল থেকেই ছিল একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। মিয়ানমারই বরং আগ্রাসন চালিয়ে আরাকান জবর দখল করেছে। আরাকানে ইসলামের আগমনও ঘটেছে রাসূল সা:-এর সময়েই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক বিশিষ্ট গবেষক ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দের মতে, ‘হিজরি প্রথম শতকের শেষ দিকে (৯৬ হিজরি) ৭১২ খ্রিস্টাব্দে উমাইয়া শাসনামলে মুসলিম সেনাপতি মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সিন্ধু অঞ্চলে ইসলামের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে ইসলামের প্রতিষ্ঠা শুরু হলেও মূলত পবিত্র মক্কায় ইসলাম প্রতিষ্ঠার প্রায় সমসাময়িক কালে মহানবী (সা) এর জীবদ্দশাতেই ভারতীয় উপমহাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিশেষত আরাকান অঞ্চলে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছায়। কেননা খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্ব থেকে আরব বণিকরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ভারত, বার্মা ও চীনের ক্যান্টন বন্দরে বাণিজ্যিক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সে সূত্রেই আরবের কুরাইশরাও ইসলামপূর্ব যুগেই এ বাণিজ্যপথে তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করেন। বিশেষত পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য (ইরান) ও রোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে অব্যাহত যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে আরবদের স্থলবাণিজ্যপথ মারাত্মকভাবে বিপদসঙ্কুল হয়ে পড়েছিল। ইয়েমেন ও হাজরা মাউতের আরব বণিকদের নৌবাণিজ্যের পূর্ব অভিজ্ঞতার সুবাদে আরবের কুরাইশরাও নৌবাণিজ্যে আগ্রহী হয়ে পড়ে। সে সূত্রেই মহানবী (সা) এর আগমনের আগেই তারা ভারতীয় উপমহাদেশ, বার্মা, কম্বোডিয়া ও চীনের ক্যান্টন পর্যন্ত বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম শতাব্দীর সূচনালগ্নেই তারা দক্ষিণ ভারতের মালাবার, কালিকট, চেররবন্দর, তৎকালীন আরাকানের চট্টগ্রাম ও আকিয়াবের সমুদ্রোপকূলে স্থায়ী বাণিজ্যিক উপনিবেশও গড়ে তোলেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার সমসাময়িক কালের মুসলমানরাও বাণিজ্যিক কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্য করতে আসে এবং সপ্তম শতাব্দী থেকে একাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চীনা বাণিজ্যে মুসলিম প্রভাব অব্যাহত রাখে। তৎকালীন দক্ষিণ চীনের ক্যান্টন বন্দর ‘খানফু’ নামে পরিচিত ছিল। মুসলিম বণিকরা এ সময় ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল বিশেষত মালাবার এবং চট্টগ্রাম থেকে কাঠ, মসলা, সুগন্ধিদ্রব্য ও ওষুধি গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতেন। বাণিজ্যিক কারণে মুসলমানরা এসব অঞ্চল সফর করলেও মূলত ইসলাম প্রচার তাদের মুখ্য বিষয় ছিল।
চীনের কোয়াংটা শহরে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন কাদেসিয়া যুদ্ধের বিজয়ী সেনাপতি হযরত সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাসের পিতা আবু ওয়াক্কাস মালিক ইবনে ওয়াইব। এরই অদূরে তাঁর মাজার এখনো বিদ্যমান। আবু ওয়াক্কাস (রা.) মহানবী (সা)-এর নবুওয়তের সপ্তম বছরে হযরত কায়স ইবনে হুযায়ফা (রা), হযরত ওরওয়াহ ইবনে আছাছা (রা) এবং হযরত আবু কায়স ইবনে হারেছ (রা) কে সঙ্গে নিয়ে একখানা সমুদ্র জাহাজে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাণিজ্যিক পথে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বের হয়েছিলেন বলে জানা যায়। তারা উক্ত জাহাজে প্রথমত ভারতের মালাবারে এসে উপস্থিত হন এবং সেখানকার রাজা চেরুমল পেরুমলসহ বহুসংখ্যক লোককে ইসলামে দীক্ষিত করে চট্টগ্রামে এসে যাত্রা বিরতি করেন। অতঃপর তিনি ৬২৬ খ্রিস্টাব্দে চীনের ক্যান্টন বন্দরে গিয়ে উপস্থিত হন। আবু ওয়াক্কাস (রা)-এর দলটি ৬১৭ খ্রিস্টাব্দে রওয়ানা দিয়ে প্রায় নয় বছর পর চীনে পৌঁছান। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, এ ৯ বছর তারা পথিমধ্যে বাণিজ্যিক কেন্দ্রগুলোতে ইসলাম প্রচারের কাজে ব্যয় করেছেন। কারণ চীনে আগমনের জন্য আরব দেশ থেকে রওনা করলে বাতাসের গতিবেগের কারণে বিভিন্ন স্থানে নোঙর করতে হতো। বিশেষত বণিকেরা এ ক্ষেত্রে মালাবার, চেরর, চট্টগ্রাম, আকিয়াব, চীনের ক্যান্টন প্রভৃতি স্থানে জাহাজ নোঙর করত। অতএব, অনুমান করা যায় যে, তিনি মালাবারের পর চট্টগ্রাম ও আকিয়াবেও জাহাজ নোঙর করে ইসলাম প্রচারের কাজ করেছেন এবং সে সূত্রেই হিন্দের (বৃহত্তর ভারতের কোন অঞ্চলের) জনৈক রাজা কর্তৃক মহানবী (সা)-এর কাছে তোহফা পাঠানোর উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত আবু সাইদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হিন্দের জনৈক শাসক মহানবী (সা)-এর কাছে এক পোঁটলা হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন যার মধ্যে আদাও ছিল। মহানবী (সা) সাহাবীদেরকে তার (আদার) এক টুকরা করে খেতে দিয়েছিলেন এবং (রাবি বলেন) আমাকেও এক টুকরা খেতে দেয়া হয়েছিল। হিন্দের কোন শাসক মহানবী (সা)-এর কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। তবে, রুহমি রাজ্যের শাসকরা বহুকাল আগে থেকেই পারস্যের শাসকদের কাছে মূল্যবান হাদিয়া-তোহফা পাঠাতো। সম্ভবত এ রুহমি রাজাদেরই কোনো রাজা মহানবী (সা)-এর কাছে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, রুহমি রাজ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের তথ্য থাকলেও বেশির ভাগ ঐতিহাসিক রুহমি বলতে আরাকান রাজ্যকে বুঝিয়েছেন। কেননা, আরাকানের পূর্ব নাম ‘রোখাম’। এটি আরবি শব্দ; যার অর্থ শ্বেতপাথর এবং আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ের পূর্বনাম কায়াকপ্রু। এটি বার্মিজ শব্দ; যার অর্থও শ্বেতপাথর। এদিক থেকে কায়াকপ্রু অঞ্চল ও রোখাম একই অঞ্চল। সে কারণে রুহমি বলতে রোখাম বা আরাকানকেই বোঝানো যায়। মনে করা হয় যে, রোখাম শব্দটির বিকৃতরূপই রুহমি। তবে কেউ কেউ রুহমি বলতে রামুকে বুঝিয়েছেন। যদি এটা ধরে নেয়া হয় তবুও আরাকানই হয়। কেননা তখন রামু আরাকানেরই অংশ ছিল। তা ছাড়া হাজার বছরের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আরাকানের ঐতিহ্যও অস্বীকার করা যায় না।’
পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জাতি

জাতিসংঘের বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। ‘রোহিঙ্গা’ শব্দের অর্থ হলো নৌকার মানুষ, যারা সমুদ্রজলে নৌকা ভাসিয়ে মৎস্য সম্পদ আহরণ করে জীবিকা অর্জন করে।
এই একবিংশ শতাব্দীতে কি পৃথিবীর আর কোথাও এমন কোন জনগোষ্ঠী আছে যারা অসুস্থ হলে হাসপাতালে যেতে পারে না, আর হাসপাতালে গেলেও তাদের চিকিৎসা দেয়া হয় না। শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না, তরুণ-তরুণীদের বিয়ে ও সন্তান ধারণে বাধা দেয়া হয়। শত শত বছর ধরে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে বসবাস করলেও তাদের নাগরিকত্ব নেই। এত অত্যাচার-নির্যাতন নিপীড়ন সহ্য করেও বর্তমানে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করেছেন। বিভিন্ন সময়ে অত্যাচারের মাত্রা সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেলে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। সৌদি আরবে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৫ লাখ। জাতিসংঘ ও ওআইসি মিয়ানমার সরকারকে এই সা¤প্রদায়িক ও জাতিগত নিপীড়ন বন্ধের আহŸান জানালেও প্রকৃতপক্ষে সরকার তাতে কর্ণপাত করছে না। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা মুসলিমবিদ্বেষী প্রচারণা চালাচ্ছে এবং তাদের নেতৃত্বেই চলছে হত্যাযজ্ঞ, অগ্নিসংযোগ। প্রাণ বাঁচাতে ক্ষুধার্ত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধরা ছোট ছোট নৌকায় করে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়ার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশগুলোও তাদের গ্রহণ করতে চাচ্ছে না। মিয়ানমার ইতিহাসকে অস্বীকার করে বলছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অভিবাসী। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতনের পরও বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো কোন কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বিশ্ববিবেক এখানে যেন বধির। মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হলে সমস্যার সাময়িক সমাধান হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করেন, মিয়ানমারের প্রভাবমুক্ত করে রাখাইনকে আবার স্বাধীন আরাকানে পরিণত করতে পারলেই শুধু এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। তা না হলে পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ওআইসি, মুসলিম বিশ্ব ও বিশ্বের সকল মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন
আরাকান রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠায় সোচ্চার হলে এবং এ ক্ষেত্রে সার্বিক সহযোগিতার হাত প্রসারিত করলেই নির্যাতনের অবসান সম্ভব।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা সম্পর্কিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নাবলী

সাদা রঙের স্বপ্ন গুলো দিল নাকো ছুটি তাইতো আমি বসে একা

Why I Hate My Life? Steps reasonable.| Properly I hate my life Disgusting