বাংলার প্রথম নারী নবাব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জীবনের প্রাসঙ্গিক কথা

জন্ম- ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার তৎকালিন হোমনাবাদ পরগণার লাকসাম এলাকার রাক্ষুসী খরস্রোতা ডাকাতিয়া নদীর তীর ঘেষে পশ্চিমগাঁও গ্রামে নবাব ফয়জনন্নেছা জন্মগ্রহণ করেন ।
মৃত্যু- ১৯০৩ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর এ মহিয়ষী প্রথম রানী নবাব ফয়জুনেনছা চির নিদ্রায় শায়িত হন তারই নির্মিত নবাব বাড়ি জামে মসজিদের পাশে।
বাবার ইতিহাস- ইয়েমেনের অধিবাসী বিখ্যাত ব্যাক্তি হোমনাবাদ পরগনার আদী মুসলামান জমিদার সাধুবর গাজী শাহেদা তার উত্তরসরীদের মধ্যে অবস্থানকারী মোতাহের খানের পুত্র সুলতান খাঁন ওরফে গোরাগাজি চৌধুরীর পুত্র হোসেন আলী চৌধুরী গাজী শাহেদার অন্যতম বংশধর মুজাফ্ফর গাজীর কন্যা মায়মুনা বিবি ওরফে ময়না বিবিকে বিবাহের পর তাদের দুই পুত্র আশ্রাফ আলী চৌধরী ও আহম্মদ আলী চৌধুরী আর দুই কন্য আফিয়া চৌধুরানী ও আমেনা চৌধুরানী আহম্মদ আলী চৌধুরী হলেন নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর পিতা।
মাতার ইতিহাস- তার মাতৃকুল নোয়াখালী জেলার প্রাচীন নাম ভুলুয়ার অন্তর্গত ধলীয়া গ্রামে  মোগল সম্রাট শাহআলমের শাসনকালে শাহজাদা জাহাঙ্গীর খানের পুত্র হুমায়ুন খা হোমনাবাদ পরগনার জমিদারি লাভ করার পর ৬ষ্ঠ বংশধর আহম্মদ আলী চৌধূরীর পিতা জমিদার নন্দিনী আরফান্নেছার তৃতীয় সন্তান এই ফয়জুন্নেছা।
শিক্ষা- বাল্যকালে ফয়জুন্নেছার ওস্তাদ তাকে আরবী উর্দু ও ফারসিই পড়ানি একই সাথে বাংলা ও সংস্কৃতি চর্চা শিখিয়ে ছিলেন।
বিবাহিত জিবন ও সন্তান – ইয়েমানের অধিবাসী বিখ্যাত ব্যাক্তি হোমনাবাদ  পরগনার আদী মুসলমান জমিদার সাধবর গাজী শাহেদা বংশধরদের মধ্যে এক বংশের নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী অপর বংশধর বরুড়া উপজেলার কাশিমপুরের জমিদার (যা পরবর্তিতে বাউকসার নামে পরিচিত) মোহাম্মদ গাজী চৌধুরী কিশোরী ফয়জুন্নেছার বিয়ের প্রস্তাব আছে দুঃসম্পর্কীয় আতœীয় ওই জমিদার গাজী চৌধুরীর সাথে ১৮৪৯ সালে এক লক্ষ স্বর্ন মূদ্রা দেনমহরে নবাব ফয়জুন্নেছার সহিদ বিবাহ হয়। যাহা পরবর্তীতে পঞ্চাশ হাজার করে দুই কিস্তিতে ফয়জুন্নেছাকে মোহাম্মদ গাজী পরিশোধ করিয়া দেন। উল্লেখ্য  যাহা বর্তমান কয়েশ কোটি টাকার উর্দে¦, এ সম্পর্কে ফয়জুন্নেছার বড় মেয়ের ঘরের চুতুর্থ বংশধর সৈয়দা মৌছিয়া বেগম তাহাদের পারিবারিক ও ফয়জুন্নেছার বংশের ইতিহাস সম্পৃক্ত গ্রন্থ “কালে কালে” বইটিতে বর্ননা করেন। শোনা যায় তিনি মহরানা বাবদ প্রাপ্ত বিশাল এই অর্থ জনহিতকর কাজে লাগিয়েছিলেন। যাহা তাহার পরবর্তিতে নবাবী উপাধী পাওয়ার জন্য সহায়ক হয়। বিবাহীত জীবনে তিনি শশুর বাড়ীতে ছিলনা বল্লেই চলে তার দুই মেয়ে ছিল, বড় মেয়ে আসাদুন্নেছা বাবা মোহাম্মদ গাজী চৌধুরীর কাছে ও ছোট মেয়ে বদরুন্নেছা মায়ের কাছেই মানুষ হয়।
কর্ম জীবন- ১৮৮৫ সালে মায়ের মৃত্যুর পর ফয়জুন্নেছা জমিদারীর দায়িত্ব তুলে নিয়ে কর্মতৎপরতার মাধ্যমে নিজেকে গড়ে তুলেন একজন সুদক্ষ, প্রজাহিতৈষী, শিক্ষানুরাগী, তেজস্বী ও বিচক্ষণ শাসক হিসাবে। তিনি পিতা-মাতার শোককে হাতিয়ার করেই দীর্ঘ ২১ বছর জমিদারী শাসনে হয়ে উঠেন জীব সংগ্রামের এক অনন্যা মহিয়ষী নারী। হঠাৎ করে ১৮৮৯ সালে ফয়জুন্নেছার স্বামী দারুন ব্যাথা যন্ত্রনা নিয়ে কুমিল্লা শহরের নিজ বাড়ীতে মৃত্য বরন করেন। কুমিল্লা সৈয়দ বাড়ীর পারিবারীক কবর স্থানে তাকে সাহিত করা হয়। জমিদার ফয়জুন্নেছার সমগ্রজীবন ছিল নিয়মতান্ত্রিক ও শৃঙ্খলার মধ্যে। জমিদারী পরিচালনা ছাড়াও তার দুটি প্রধান সাধনা ছিল আল্লাহর ইবাদত এবং সাহিত্য সাধনা । নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীর জমিদারীর ১৪টি মৌজা ছাড়াও দেশে-বিদেশে ১৪টি প্রাথমিক মক্তব, প্রাথমিক বিদ্যালয়, দ্বনিয়াত শিক্ষা, হাইস্কুল , বালিকা বিদ্যালয়, কলেজ মাদ্রাসা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান, দাতব্য চিকিৎসালয়, হাসপাতাল, দিঘী-পুকুর, মসজিদ, মুসফিরখানা, পুল-ব্রিজ, পত্র পত্রিকায় পৃষ্ঠপোষকতা, কবি সাহিত্যিকদের সাথে যোগাযোগ, ফয়জুন পাঠাগার, রূজালাল গ্রন্থ রচনাসহ বিভিন্ন জনহিতকর কাজ করে গেছেন তিনি। এছাড়া ১৮৯৪-৯৫ সালে মক্কাশরীফে হজ্বব্রত পালন করতে গিয়ে ওই দেশের বাদশা আব্বাসিয়া খলিফা হারুন রশিদের স্ত্রী নামে যোবায়দা নহর পুনঃখনন এবং একটি মুসাফিরখানা স্থাপন করেন। ১৮৯১ সালে ১৮ইজুন তার স্থাবর অস্থাবর সকল সম্পত্তি জনকল্যানে ওয়াকফ করে দেন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাহা আজ পর্যন্ত জনহিতকর ও ধর্মীয় কাজে ব্যাবহৃত হচ্ছে
নবাবী উপাধী পাওয়া ইতিহাস-তৎকালিন ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মিঃ ডগলাস জনকল্যানমুখি কাজে অর্থ যোগানের জন্য দেশের সকল জমিদারদের কাছে চিঠি পাঠান। এ সময় ২৪ পরগনার ব্রিটিশ গর্ভনর ছিলেন লর্ড কার্জন। বিশাল পরিমান অর্থ যোগানের কথা ভেবে ওই জনকল্যানমুখী কাজে দেশের অন্যান্য জমিদাররা টাকা দিতে অপরাগতা প্রকাশ করলে শেষ মুহর্তে হোমনাবাদ ১৪ পরগনার জমিদার ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী নিজেই ঋণ হিসাবে নয় জনকল্যানে সম্পুর্ন টাকা তিনি দান করেন। টাকার পরিমান ১লক্ষ টাকা হলেও বর্তমান যার পরিমান ৬৫ কোটি টাকা। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন ভিক্টোরিয়া মহারানী বিশ্বের একজন মুসলিম নারী জমিদারের মহানুভবতা ও দানশীলতায় মুগ্ধ হয়ে রানী ফয়জুন্নেছাকে বেগম উপাধিতে ভুষিত করলে  তিনি সম্মানের সাথে প্রত্যাখান করেন। মহিলা জমিদার হিসাবে তিনি এমনিতেই বেগম বলে পরিচিত। রানী ভিক্টোরিয়ার রাজ দরবারে পুনরায় পরামর্শ করে ফয়জুন্নেছা চৌধুরানীকে নবাব উপাধিকে ভুষিত করার সিদ্ধান্ত নেন যা ১৮৮৯ খ্রিঃ সেই খেতাব প্রদান অনুষ্ঠানটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল বর্তমান কুমিল্লার দক্ষিন চর্থা সৈয়দ বাড়ীর মাঠে।
বিভিন্ন খেতাব – ১৮৮৯ খ্রিঃ নবাবী খেতাব ১৯৯৬ সালে একুশে পদক ও বিভিন্ন নারী বিষয়ক খেতাবে ভুষিত হন।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনার ময়না ঘরে থুইয়া বাইরে তালা লাগাইছে রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিন্জর বানাইছে

মানুষ কখনো ইচ্ছে করে বদলায় না কিছু মানুষের অবহেলা, কিছু স্মৃতি

ঘাসফুলেদের সাথে আমি একাই কথা বলি ঘাসফুল গুলো সব ছন্নছাড়া।