আইসিসির আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ভারত থেকে। তাই আইসিসিতে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। ভারতের আছে ১২৫ কোটি জনগণ। ক্রিকেট বিশ্বের অন্যান্য সব দেশ মিলিয়েও এত জনগণ হবে না। তাই আইসিসি ক্রিকেটের বিশ্বায়নের কথা চিন্তা না করে কীভাবে ভারতের জনগণকে ক্রিকেট ‘খাইয়ে’ অর্থ উপার্জন করবে, সেই চিন্তাই করে। আর অর্থ উপার্জনের জন্য আইসিসির সবচেয়ে বড় ইভেন্ট ক্রিকেট বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপের শুরুতেই ভারত বাদ মানে, আইসিসির বিরাট লোকসান। ভারতকে যত দূর পর্যন্ত নেওয়া যাবে, আইসিসির আয়ও তত বাড়বে। আর সে জন্য বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা ছোট করতেও আপত্তি নেই আইসিসির। এমনকি বিশ্বকাপ হাস্যকর ফরমেশন দিতেও আপত্তি নেই আইসিসির। বিশ্বকাপ ২০০৭ ২০০৭ সালে ১৬টি দল নিয়ে ৪টি গ্রুপে ভাগ হয়ে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা ফরমেশন। প্রত্যেক গ্রুপে ৪টি দল একে অপরের সঙ্গে খেলেছে। প্রত্যেক গ্রুপে মোট ৬টি ম্যাচ হয়েছে। এভাবে ৪ গ্রুপে মোট ২৪টি ম্যাচ। এরপর প্রত্যেক গ্রুপের টপ ২টি দল সুপার এইটে খেলেছে, ২টি বাদ পড়েছে। অর্থাৎ গ্রুপ পর্বের ২৪টি ম্যাচের পরেই ৮টি দল বাদ। আইসিসির জন্য দুঃখের বিষয় বাদ পড়া ওই ৮টি দলের একটি ভারত। এরপর শুরু হয় সুপার এইট। সেখানে ৮টি দল একে অপরের সঙ্গে খেলে (গ্রুপ পর্বের সঙ্গী বাদে)। এভাবে সুপার এইটে হয় মোট ২৪টি ম্যাচ। এরপর সুপার এইটের সেরা ৪টি দল নিয়ে সেমিফাইনাল এবং পরে ফাইনাল। ২০০৭ বিশ্বকাপে মোট ৫১টি ম্যাচ হয়। অথচ ২৪ ম্যাচ পরেই ভারত বাদ। সেখানে ভারতের গ্রুপের ম্যাচ ছিল মাত্র ৬টি এবং ভারত খেলেছে ৩টি ম্যাচ। অর্থাৎ বিশ্বকাপের ৫১টি ম্যাচের মধ্যে ভারতীয় সমর্থকেরা আগ্রহ নিয়ে দেখেছে মাত্র ৩-৪ টি ম্যাচ। তাহলে কি পরিমাণ লোকসান বা লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছে আইসিসি, একবার চিন্তা করুন। টুর্নামেন্টের অর্ধেক না যেতেই যদি ১২৫ কোটি দর্শক হারায়, তাহলে পুরো ইভেন্টটাই ফ্লপ যাবে। তাই পরের আসরেই পুরো ফরমেশনেই ব্যাপক পরিবর্তন আনে আইসিসি। বিশ্বকাপ ২০১১ বিশ্বকাপের ফরমেশন পরিবর্তন করে ১৪টি দল নিয়ে ২টি গ্রুপে ভাগ হয়ে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়। প্রত্যেক গ্রুপে ৭টি দল একে অপরের সঙ্গে খেলে। এভাবে প্রতি গ্রুপে ২১টি ম্যাচ এবং ২ গ্রুপ মিলিয়ে ৪২টি ম্যাচ হয়েছে। অর্থাৎ ৪২ ম্যাচ পর গ্রুপ পর্বের খেলা শেষ হয়। এবার ভারত ছোট দলের বিপক্ষে একটা ম্যাচ হারলেও কোনো অসুবিধা হবে না। ৬ ম্যাচের মধ্যে ৩-৪ টা জিতলেই কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত। আর ভারত কোয়ার্টার ফাইনালে মানে গ্রুপ পর্বের ৪২ ম্যাচের পর কোয়ার্টার ফাইনালের ৪ ম্যাচেও দর্শক থাকবে। ২০১১ বিশ্বকাপে মোট ৪৯টি ম্যাচ হয়। ভারত চ্যাম্পিয়ন হয়। পুরো বিশ্বকাপেই নজর ছিল ভারতের ১২৫ কোটি জনগণের এবং বহির্বিশ্বের ক্রিকেট সমর্থকদের। আইসিসির সবচেয়ে লাভবান বিশ্বকাপ, ভারতেরও! বিশ্বকাপ ২০১৫ এবারের ফরমেশন অনেকটা ২০১১ এর মতোই। গ্রুপ পর্বেই ১৪টি দলের মোট খেলা হয় ৪২টি ম্যাচ। বিশ্বকাপের মোট ৪৯টি ম্যাচের মধ্যে ভারত নিশ্চিত ছিল প্রথম ৪২ ম্যাচ পর্যন্ত। এ সময়ে আইসিসি সারা বিশ্বের দর্শকদেরই ধরে রেখেছিল। ১০টি টেস্ট খেলুড়ে দলের পাশাপাশি ৪টি সহযোগী দল ছিল। সহযোগী দেশগুলো খেলেছে ২৪টি ম্যাচ। ম্যাচের ফলাফল যেমনই হোক, আইসিসি​র কাছে এগুলো স্রেফ লোকসান। এই ম্যাচ বড় দলগুলোর মধ্যে হলে লাভ আরও বেশি হতো। গ্রুপ পর্বের ৪২ ম্যাচ পরেও যদি ভারত বাদ যায়, এরপরও আইসিসির লোকসান নেই। কারণ তখন টুর্নামেন্টের মাত্র ৭টি ম্যাচ বাকি। এবার ভারত হেরেছে ২য় সেমিফাইনালে। অর্থাৎ এরপর ছিল মাত্র ১টি ম্যাচ। টুর্নামেন্টের ৪৯ ম্যাচের ৪৮টা পর্যন্ত ভারত টিকে ছিল, আগ্রহ ছিল তাদের দর্শকদেরও। আর ফাইনালের প্রতি আগ্রহ তো থাকবেই। তাই এই বিশ্বকাপেও আইসিসির অনেক লাভ হয়েছে। ভারত ফাইনালে উঠলে আরেকটু বেশি হতো। কিন্তু এই লাভেও যেন পোষাচ্ছে না আইসিসির। তাই ২০১৯ বিশ্বকাপকে নতুন ছক। বিশ্বকাপ ২০১৯ এমন চিন্তা কেবল আইসিসির পক্ষেই সম্ভব। তারা এবার বিশ্বকাপটাকে ১৪ দল থেকে কমিয়ে ১০ দলে নিয়ে এসেছে। তাহলে কেমন হবে ২০১৯ বিশ্বকাপ? তখন কোনো গ্রুপই থাকবে না। ৮টি দল সরাসরি সুযোগ পাবে, বাকি ২টি দল বাছাই পর্ব খেলে আসবে। এই ১০টি দল প্রত্যেকে প্রত্যেকের সঙ্গে খেলবে। এভাবে প্রথম পর্বে ম্যাচ হবে ৪৫টি। দেখুন, আগে প্রথম পর্বে হতো ৪২টি আর ২০১৯ সালে হবে ৪৫ টি। আগে সহযোগী দলর ‘অলাভজনক’ ম্যাচগুলো এবার না রাখার ব্যবস্থাই আইসিসি করে রেখেছে। ২০১৯ সালে খেলবে সবগুলো বড় দল। আগে এক গ্রুপের ম্যাচ হলে অন্য গ্রুপের দলের দর্শকদের আগ্রহ থাকত না, অন্য গ্রুপের পয়েন্টের​ সমীকরণ তো আর প্রভাব ফেলছে না যে হিসাব রাখতে হবে। কিন্তু ২০১৯ সালে সবাই একই গ্রুপে। নিজেদের ম্যাচগুলোর পাশাপাশি বাকি দলগুলো কে কেমন করছে, সেটাতে চোখ রাখতেই হবে। দলের সংখ্যা কমলেও বাণিজ্যিকভাবে বেশি লাভ। এরপর সেমিফাইনালে ২ ম্যাচ আর ফাইনাল। ৪৮ ম্যাচের বিশ্বকাপ। এর মধ্যে ৪৫ ম্যাচ পর্যন্তই সবগুলো দল বিশ্বকাপে টিকে থাকবে। ভারত যদি খারাপও খেলে, এরপরও ৪৫ ম্যাচ পর্যন্ত ভারতের ১২৫ কোটি দর্শক থাকবে। এরপর ভারত বাদ গেলেও আর অসুবিধা নেই। এ জন্যই আইসিসি সহযোগী দলগুলোকে রাখতে চাচ্ছে না। ওরা থাকলে বিশ্বকাপের ৫০% ম্যাচেই দর্শকদের আগ্রহ থাকে না। ২০১৯ বিশ্বকাপেই আয়ারল্যান্ড নাও থাকতে পারে। অথচ আয়ারল্যান্ড ২০০৭ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে, ২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে এবং ২০১৫ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছে। আফগানিস্তান উঠে আসছে। নেপালের ক্রিকেট কিন্তু অনেক দ্রুত উন্নতি করছে। কয়েক বছর আগেও যেমন নেপালের দর্শকেরা বিশ্বকাপ খেলা স্বপ্ন দেখত, কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। নেপালে একেকটা ক্রিকেট ম্যাচে কী পরিমাণ দর্শক মাঠে থাকে, দেখলে আপনি অবাক হয়ে যাবেন। আয়ারল্যান্ডের অধিনায়ক পোর্টারফিল্ড তো বলেই দিয়েছেন, ‘বিশ্বকাপই যদি না খেলতে পারি, তাহলে ক্রিকেট খেলে কী লাভ!’ অথচ এই আইসিসি মুখে ক্রিকেট ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলে, সম্প্রসারণের কথা বলে। কিন্তু ‘ভদ্রলোকে’র খেলা ক্রিকেটটা এখন স্রেফ টাকা বানানোর একটা যন্ত্র, আর কে না জানে আইসিসির কাছে ভারত হলো সোনার ডিম পাড়া হাঁস।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

সোনার ময়না ঘরে থুইয়া বাইরে তালা লাগাইছে রসিক আমার মন বান্ধিয়া পিন্জর বানাইছে

মানুষ কখনো ইচ্ছে করে বদলায় না কিছু মানুষের অবহেলা, কিছু স্মৃতি